ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায়

প্রস্রাবে ইনফেকশন বা জ্বালাপোড়া সাধারণ একটি সমস্যা। নারী পুরুষ শিশু সকলেই এই সমস্যাটির সম্মুখীন হয়ে থাকে। তবে পুরুষ ও শিশুদের তুলনায় নারীরা একটু বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রস্রাবের রং অনেক সময় হলুদ হলেই আমরা চিন্তিত হয়ে যাই হয়তো আমার প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়েছে।

প্রস্রাবের ইনফেকশন হলে মেডিকেলের ভাষায় একে বলা হয় UTI বা urinary track infection  বা বাংলায় বলা হয় মূত্রনালীর সংক্রমণ। কিডনি ছাকান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত থেকে অতিরিক্ত পানি বিভিন্ন বজ্র পদার্থ ইউরিনের সাথে শরীর থেকে বের করে দেয়। এখন আমি জানবো ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ কেন হয়- কোনো কারনে যদি আমাদের মূত্রথলি বা কিডনিতে কোন ধরনের জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ হয় ইউটিআই বা প্রস্রাবের সংক্রমণ বলা হয়।

সাধারণত কাদের বেশি প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়ে থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাধারণত তিন থেকে চার লিটার পানি পান করা উচিত। আপনি যদি প্রয়োজনের তুলনায় পানি কম পান করেন তাহলে প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে। ইচ্ছা করে প্রস্রাবের চেপে রাখলে প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে।

আপনার অনেক প্রস্রাবের চাপ আসছে কিন্তু আপনি বসেই আছেন এর ফলে আপনার প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস কিডনির কোন অসুখ ও গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। নতুন বিবাহিতদের প্রস্রাবে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে যাকে চিকিৎসকগণ বলে থাকে হানিমুন ছিসটাইজিস।

ইউরিন ইনফেকশন এর লক্ষন

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রস্রাবের ইনফেকশন বেশি হয়ে থাকে। মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তা পায়ু পথের কাছাকাছি থাকে। মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তার দীর্ঘতা বা ইউরেথ্রা ছেলেদের তুলনায় কম তাই সহজেই জীবাণু প্রবেশ করে মূত্রথলিতে ইনফেকশনের সৃষ্টি করতে পারে। প্রায় ৯০% ইনফেকশন হয়ে থাকে ইকোলাই নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা। এছাড়াও আরো কিছু জীবাণু রয়েছে যা দ্বারাও ইনফেকশন হতে পারে।

প্রস্রাবের ইনফেকশন হলে যেসব লক্ষণ দেখা যাবে তা নিম্নরূপ। লক্ষণ নির্ভর করে আপনার ইউনাইট্রাকের কোথায় ইনফেকশন হয়েছে তার উপরে। যদি ইনফেকশন শুরু হয়ে ইউরেথ্রা প্রস্রাবের রাস্তা পর্যন্ত থাকে তাহলে দুইটি লক্ষণ দেখা যায় প্রথমত প্রসবের সাথে শ্রাবের মতো কিছু বের হওয়া। দ্বিতীয়ত প্রস্রাবের রাস্তা জ্বালা পোড়া হওয়া।

ইনফেকশন যদি প্রস্রাবের রাস্তার ছাড়িয়ে মূত্রথলি পর্যন্ত চলে আসে তখন তাকে বলা হয় সিসটাইটিস। সিসটাইটিস হলে যেগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হল:
      
      ১. প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া হওয়া।
      ২. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া।
      ৩ . পেটের নিচে হালকা ব্যথা হওয়া.
      ৪. প্রস্রাবের রং পরিবর্তন হওয়া প্রস্রাব ঘোলাটে হওয়া। অনেক সময় প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে।

ইনফেকশন যখন কিডনিতে হয় তখন তাকে বলা হয় পাইলোন্যাফ্রাইটিস তখন যে লক্ষণ গুলো প্রকাশ পায় তা হল শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। বমি বমি ভাব বা বমি করা। পেট ও পিঠে তীব্র ব্যথা হওয়া। এই লক্ষণ গুলো দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়েছে। এছাড়াও আপনি প্রস্রাবের পরীক্ষা করেও নিশ্চিত হতে পারেন।

ইউরিন ইনফেকশনের ঔষধ

প্রস্রাব করতে জ্বালাপোড়া হওয়া। বা প্রস্রাবের সময় প্রসবের রাস্তায় ব্যথা হওয়া কিংবা তলপেটে ব্যথা হওয়া অনেক সময় আবার প্রস্রাব করতে না পারা প্রস্রাব আটকে যাওয়া এই ধরনের সমস্যাগুলো অনেকেরই হয়ে থাকে। এই ধরনের সমস্যা জন্য অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদি আপনি ঘরে এর সমাধান করতে চান তাহলে পরিমাণ মতো পানি পান করুন দিনে তিন থেকে চার লিটার। এছাড়াও আপনি কিছু ঔষধ সেবন করে প্রস্রাবের ইনফেকশন দূর করতে পারেন
যেমন :
  • ইউ রিসেট, 
  •  ইউরোম্যাক্স 
  •  সি কে 
  •  ইউরিক্যাল 
  •  লুভোনা 
  •  ফ্লুগাল ৫০
  •   ইউরোকিট প্লাস
তবে ওষুধ সেবনের পূর্বে আপনি অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।

ইউরিন ইনফেকশন হলে কি সমস্যা হয়

ইউরিন ইনফেকশন হলে আপনি যদি সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা না নেন তাহলে আপনার সমস্যা অনেক গুণে বেড়ে যাবে। আপনার যদি সাধারণ ইউরিন ইনফেকশন ছিল সেটা ধীরে ধীরে  প্রস্রাবের রাস্তা ছাড়িয়ে সিসটাইটিস বা মূত্রথলি পর্যন্ত চলে আসে।

আবার এটি আরও ভয়াবহ পর্যায়ে যেতে পারে এটি আবার পাইলোনেফ্রাইটিস বা কিডনি সংক্রমণ হতে পারে এর ফলে একসঙ্গে দুই কিডনি ফেল হতে পারে। আবার যদি একটা কিডনিতে সংক্রমণ হয় তাহলে সে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে বা অকার্যকর হতে পারে। 

তাহলে আপনি ভাবুন সাধারণ একটি রোগ ছিল আপনি সময়মত যদি এর চিকিৎসা না করেন তাহলে প্রথমে প্রস্রাব থলি বা মূত্রথলির ক্ষতি হবে। মূত্রথলি ছোট হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সারা জীবন আপনার ঘন ঘন প্রসাব করতে হবে। চিকিৎসকের কাছে যতই যান  চিকিৎসকগন  তখন বলবে এটা তো আর সারানো যাচ্ছে না।

আর যদি রিফ্লাক্স থাকে তাহলে পাইলোনেফ্রাইটিস হয়ে পুরো কিডনিটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সবশেষে যদি তাও চিকিৎসা না হয় এর ফলে প্রস্রাবের থলি থেকে প্রসবের সাথে রক্ত বের হয়ে যাওয়া যেটাকে ডাক্তারের ভাষায় বলা হয় হিমাথিওরিয়া বা প্রস্তাবের সাথে রক্ত বেরিয়ে যাওয়া আর সবশেষে হতে পারে কিডনিতে পাথর। 

ফসফেট জাতীয় পাথর যদি ইনফেকশন টা প্লেপসিয়া বা প্লটিয়াস এই জাতীয় জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ হয় তাহলে কিডনির মধ্যে অনেক বড় বড় পাথর যে পাথরকে চিকিৎসকেরা নাম দিয়েছেন স্টক হ্যান্ড স্টোন বাংলায় যাকে বলে হরিণের সিং এর মতো পাথর যেমন পুরুষ হরিণের মাথায় শিং থাকে অনেক ডালপালা ওয়ালা সেরকম প্রত্যেকটা কিডনি ভরে যাবে এসব পাথর দ্বারা।

প্রস্রাবের থলিতে ও স্টক হ্যান্ড স্টোন বা পাথর হতে পারে প্রস্রাবে ইনফেকশনে কারণে। তাহলে প্রস্রাবের ইনফেকশন ছিল একটি সাধারণ রোগ যেটা একটা অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই সেরে যেতো সেটা আপনার অবহেলার কারণে প্রথমে সিসটাইটিস হলো। রিফ্লাক্স হয়ে কিডনি নষ্ট হয়ে গেল। আবার পাইলোনেফ্রাইটিস হয়ে কিডনি নষ্ট হয়ে গেল শুধুমাত্র সাধারণ একটি রোগ ইউরিন ইনফেকশন থেকে। তাহলে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে এসব বিষয়ে।

ইউরিন ইনফেকশন হলে খাবার

সাধারণত ইনফেকশনের সমস্যা মেয়েদের অনেক বেশি হয়ে থাকে যেহেতু তারা দীর্ঘ সময় নিজের প্রসাব আটকে রাখে পাশাপাশি তাদের খাবার তালিকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার কম থাকে। যেসব মেয়েরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঠিক রাখে না বা খাবার তালিকা ঠিকমতো নির্ধারণ করে না এবং দেখা যায় যে টয়লেট যখন আসে তখন সময় মত হয় না তাদের অনেকেরই কিন্তু ইউরিন ইনফেকশন দেখা দেয়।

ইউরিন ইনফেকশন হলে আপনাকে কি ধরনের খাবার খেতে হবে তা নিম্নরূপ, অনেকেই আছেন যারা ইউরিন ইনফেকশন হলে সাইট্রাস যুক্ত খাবারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যেমন লেবু কমলা মালটা খুব বেশি পরিমাণে খায় তাদের ধারণা যে ইউরিন ইনফেকশনটা সেরে যাবে।

কিন্তু সাইট্রাস যুক্ত ফল আপনার যখন ইউরিন ইনফেকশন হবে ওই সময়টাতে খাওয়া যাবেনা। আপনাকে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার অবশ্যই খেতে হবে। তবে সেগুলো  যেসব খাদ্যে সাইট্রাস কম রয়েছে সেসব খাদ্য থেকে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। ‌

যেমন টমেটো গাজর পেঁপে এই ধরনের খাবারগুলো আপনাকে খেতে হবে। আপনি চাইলে বড়ই এটাও গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু সাইট্রাক্স যুক্ত খাবার আপনার ইউরিন ইনফেকশনের সময় খাওয়া যাবে না। এছাড়া প্রোবায়টিক সম্পন্ন খাবার খাওয়া যাবে। প্রোবায়টিক সম্পন্ন খাবার বলতে দই, টক দই এগুলো কিন্তু আপনার ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করবে। 

এছাড়া যেমন আপনার সবুজ শাকসবজি রয়েছে পালং শাক, পুঁইশাক এগুলো আপনি গ্রহণ করতে পারেন এগুলো খুব সহজে আপনার ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করবে। ইনফেকশন দূর করতে আপনি ডাবের পানি শরবত ফলের রস এসব কিছু খেতে পারেন। এছাড়া আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করবেন সারা দিনে অন্তত তিন হতে চার লিটার পানি পান করবেন যা আপনার প্রসবের ইনফেকশন থেকে দূরে রাখবে।

বার বার ইউরিন ইনফেকশন

ইনফেকশন মানে যেখানে রোগ জীবাণু প্রবেশ করে প্রদাহ সৃষ্টি করে তবেই সেটা ইনফেকশন। আজকে ইনফেকশন ভালো হয়ে গেল আগামী বছর আবারো আপনার ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। প্রস্রাবের ইনফেকশন মানে হলো ঘন ঘন প্রসাব হওয়া, প্রসবের রাস্তা জ্বালাপোড়া করা, তলপেটে ব্যথা হওয়া, গায়ে জ্বর থাকতে পারে শেষমেষ  প্রস্রাব দিয়ে রক্ত যেতে পারে। তাহলে কতগুলো সমস্যা একসাথে হলে আমরা ইউরিন  ইনফেকশন বলতে পারি। এরপর ইউরিন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে ইনফেকশন হয়েছে কিনা।

প্রস্রাবের অতি সাধারণ পরীক্ষা রুটির এক্সামিনেশন অফ ইউরিন যা ডাক্তারেরা সংক্ষেপে বলে  Urine R/E বা urine colour এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ইনফেকশন আবার হয়েছে কিনা। যদি বারবার ইনফেকশন হতে থাকে এর প্রধান কারণ হলো সঠিক চিকিৎসা বা সঠিক ওষুধের প্রয়োগ না হওয়া। যদি ইউরিন ইনফেকশনে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক বা ঔষধ সেবন করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চলাফেরা ও নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সেবন করলে বারবার ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

তবে ডায়াবেটিস রোগীদের বারবার ইউরিনের ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেটা যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এটি ব্লাডে ছড়িয়ে গিয়ে কিডনি কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ইউরিন ইনফেকশন দূর করার উপায় 

ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে হলে সর্বপ্রথম যা করতে হবে তা হল পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে প্রতিদিন। অবশ্যই এক্ষেত্রে যা হবে তাহলো আপনার ইউরিন ইনফেকশনের কারণে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছ তা ধীরে ধীরে কমে যাবে। এর পাশাপাশি আপনি যদি উপরের লক্ষণগুলো দেখতে পান তাহলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এর সাথে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। 

এ সময় ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেতে হবে তবে সাইট্রাস ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখা যাবেনা। যৌন মিলনের আগে ও পরে আপনাকে অবশ্যই প্রস্রাব করে নিতে হবে এটি আপনার শরীরে ফ্ল্যাশের মত কাজ করবে। মেয়েদের মাসিকের সময় অবশ্যই সেনেটারি পেট বা সুতি অন্তঃবাস পরিধান করবেন। স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের ফলেও ইউরিন ইনফেকশন দূরে রাখা যায়।

সর্বশেষ পরামর্শ

এছাড়া আপনি যত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ততই বাড়বে এবং ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনাটাও অনেকাংশে কমে যাবে। তাহলে আমাদের সচেতনতা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সঠিক নিয়মে ওষুধ সেবন করার মাধ্যমে আমরা ইউরিন ইনফেকশন থেকে দূরে থাকতে পারি।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url